বৃহস্পতিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৩, ১২:৪৪ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক, সোনারগাঁও নিউজ :
রূপগঞ্জের গঙ্গানগর এলাকায় সড়ক দূর্ঘটনায় নিহত দম্পত্তি তাহমিনা ও বাবুর দীর্ঘ চার বছর ভালোবাসা পর ২০১৫ সালের বিয়ের মাধ্যমে তাদের সংসার জীবন শুরু। ২০১০ সালে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে তাদের পরিচয় হয়। বিয়ে করে দুই পরিবারের অমতে। প্রথম দিকে তাহমিনার পরিবার মেনে নেয় তাদের সর্ম্পককে। পরবর্তীতে তাদের কন্যা সন্তান জন্মের পর উভয় পরিবার তাদের বিয়েকে মেনে নেয়। বিয়ের পর শপথ ছিলো মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তারা হাতে হাত রেখে এক সঙ্গে থাকবেন। তাই-ই হলো । মৃত্যুর পর পাশাপাশি তাদের লাশ হয়ে শুয়ে আছে। আল্লাহ তাদের দুজনের শপথ কবুল করেছেন। তবে তাদের ঔরসজাত এক সন্তানকে একাই রেখে গেছেন এ পৃথিবীতে। সড়ক দূর্ঘটনায় নিহত তাহমিনার চাচা আবুল কাশেম কান্না জড়িত কন্ঠে আবেগ আপ্তুল্ল হয়ে এমন কথা বলেন।
শনিবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও পৌরসভার নয়ামাটি গ্রামে নিহতের বাড়িতে গেলে এমন কথা বলেন তিনি। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় ৭টার দিকে রূপগঞ্জের কা ন-রূপসী সড়কের গঙ্গানগর এলাকায় মোটরসাইকেল দূর্ঘটনায় নাজমুল ইসলাম বাবু (৩৪) ও তাহমিনা আক্তার (৩০) দম্পত্তি মারা যান। আহত হয় তাদের একমাত্র মেয়ে তাহরিন জাহান ফাহা (৬) । তাকে ঢাকার একটি বেসরকারী ক্লিনিকে নিবীড় পর্যবেক্ষন কেন্দ্র (আইসিইউতে) চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
নিহত তাহমিনার চাচা আবুল কাশেম জানিয়েছেন, তার ভাতিজির জামাই এলাকায় সকলের কাছে খুব ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিল। ২০১৫ সালে ভালোবেসে তারা একে অন্যকে বিয়ে করেছেন। বিয়ের পর থেকে এ বাড়িতেই তাদের বসবাস। ভাতিজি তাহমিনা আক্তার স্থানীয় বালুয়া দিঘিরপাড় চাইল্ড হোম কিন্ডারগার্টেনে শিক্ষকতা করতেন। পাশাপাশি বাড়িতেই টিউশনি করতেন। তার স্বামী ভবন নির্মাণের ঠিকাদারী ব্যবসা করতেন।
তিনি আরো জানান, তাহমিনা আক্তারের মেয়ে তাহরিন জাহান ফাহা বালুয়া দিঘিরপাড় চাইল্ড হোম কিন্ডারগার্টেনে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে। মায়ের সঙ্গেই স্কুলে আসা যাওয়া করতো। এখন আর কে তাকে স্কুলে নিয়ে যাবে? আল্লাহ আমাদের এতো বড় শাস্তি দিলো কেন?
নিহত তাহমিনার বাবা আলাউদ্দিন বলেন, মৃত্যু তাদের আলাদা করতে পারেনি। ভালোবেসে বিয়ের পর তাদের মৃত্যু হয়। মেয়ের জামাই বাবুর পরিবারের সম্মতিতেই তাদের একই কবরস্থানে পাশাপাশি দাফন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, গত শুক্রবার জুমা নামাজের পর রূপগঞ্জের পূর্বাচলে বেড়াতে গিয়ে দূর্ঘটনায় শিকার হয়ে মারা যান তারা। দুপুরে তার মেয়ে তাহমিনা ভালো খাবার রান্না করেছেন। মাংস থেকে শুরু করে অনেক কিছু রান্না করে গেছে। রাতে তাদের বন্ধুরা আসবে। সঙ্গে এক সাথে খাবার খাবে। এ খাবার তাদের ভাগ্যে জোটে নি।
নিহত নাজমুলের বাবা নাজিমউদ্দিন জানিয়েছেন, এ মৃত্যুর জন্য তারা কাউকে দায়ী করছেন না। ফলে মামলা বা বিনা ময়না তদন্তে লাশ নিয়ে এসেছেন।
তার ভাষ্য, মামলা করেও কোন লাভ হবে না। হয়রানির শিকার হতে হবে। যাদের জন্য মামলা করবো তারাই তো নেই। ছেলে দীর্ঘদিন এখানে বসবাস করেছে। বসবাসের সুবাদে এখানে অনেক সৎজ্জন তৈরি হয়েছে। আমাদের পারিবারিক সিদ্ধান্তে বৌ ও ছেলেকে পাশাপাশি কবরে দাফন করা হয়েছে।
গতকাল শনিবার সকাল ৯ টায় পৌর এলাকার বালুয়াদিঘির পাড় হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা মাঠে দুজনের জানাযা শেষে সামাজিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। তাদের উপস্থিত জানাযায় তাদের জন্য অনেকেই চোখের পানি ফেলেছেন।
কান্না জড়িত অবস্থায় নিহত নাজমুল ইসলাম বাবুর মা এসে উম্মে কুলসুম লুৎফা বলেন, তার ছেলে বিয়ের পর থেকেই তার শ্বশুর বাড়িতে স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে বসবাস করেন। বাবার দেখানো ঠিকাদারী ব্যবসা করতেন। বাবা নাজিমউদ্দিন নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার মধ্যম শান্তিপুর গ্রামে থেকেই ঠিকাদারী ব্যবসা করেন। বাবুর বাবা চলতি বছরের আগষ্ট মাসে অন্য একটি দূর্ঘটনায় পা ভেঙ্গে আহত হয়েছেন। তারা বাবা আহত হওয়ার পর থেকে তার ব্যস্ততা বেড়েছে। তার ব্যবসা দেখাশোনার পাশাপাশি তার বাবার ব্যবসাও দেখাশোনা করতেন বাবু। নাজমুল ইসলাম বাবুরা ৪ ভাই এক বোন। সে সবার বড় ছেলে।
তার মা আরো বলেন, ২০১২ সাল থেকে সে মোটরসাইকেল ব্যবহার করতেন। এ নিয়ে সে চারটি মোটরসাইকেল পরিবর্তন করেছেন। সড়ক দূর্ঘটনায় পতিত এ্যাপাচি মোটরসাইকেলটি তিন মাস আগে কুমিল্লার একটি শো-রুম থেকে ক্রয় করেন। এ মোটরসাইকেল নিয়ে অবসর সময় পেলেই স্ত্রী সন্তান নিয়ে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ঘুরে বেড়াতেন তারা।
এদিকে এলাকাবাসী জানায়, নিহত দম্পত্তি খুব ভালো প্রকৃতির ছিল। সকলের সঙ্গে তাদের সু-সম্পর্ক ছিল। সময় পেলে তারা বেড়াতে বের হতেন। ভালোবেসে এক সঙ্গে ঘর বেঁধে এক সঙ্গে মৃত্যুর হয় তাদের।
উল্লেখ, গত শুক্রবার দুপুর তিনটার দিকে নাজমুল ইসলাম বাবু স্ত্রী–সন্তানসহ নিজের মোটরসাইকেলে চড়ে রূপগঞ্জের পূর্বাচলে বেড়ানো শেষে বাড়ি ফেরার পথে সন্ধ্যা সাতটার দিকে কা ন-রূপসী সড়কের গঙ্গানগর এলাকায় এলে একটি প্রাইভেট কার পেছন থেকে সেটিকে ধাক্কা দেয়। এতে মোটরসাইকেলে থাকা মা –বাবা ও মেয়ে ছিটকে পড়ে যায়। এসময় বিপরীত দিক থেকে দ্রæতগতিতে আসা একটি মালবাহী ট্রওাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই ওই দম্পতির মৃত্যু হয়। গুরুতর আহত হয় তাদের একমাত্র মেয়ে। আহত মেয়েকে আশপাশের লোকজন উদ্ধার করে প্রথমে স্থানীয় একটি ক্লিনিকে নিয়ে যান। পরে তাঁকে ঢাকার এ্যাপোলে হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে তাকে নিবীর পর্যবেক্ষন কেন্দ্র (আইসিইউতে) ভর্তি করা হয়। গতকাল শনিবার তার অবস্থায় উন্নতি হলে তাকে সাধারণ বিছানায় স্থানান্তর করে। দূর্ঘটনার পর পুলিশ লাশ দুটি উদ্ধার করে রূপগঞ্জ থানায় নিয়ে যায়। ঘটনাস্থল থেকে ঘাতক ট্রাকটি আটক করে পুলিশ। তবে চালক ও হেলপার পালিয়ে যায়। পরিারের কোন প্রকার অভিযোগ না থাকায় লাশ দুটি পরিবারের কাছে ময়না তদন্ত ছাড়া হস্তান্তর করে।
রূপগঞ্জ থানার ওসি এ এফ এম সায়েদ বলেন, পরিবারের আপত্তি না থাকায় লাশ দুটি পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট্র ট্রাকটি আটক করা হয়েছে। মামলা প্রক্রিয়াধীন। তাদের পরিবার শোকাহত থাকায় মামলা রুজু করা হয়নি। নিহতদের পরিবারকে খবর দেওয়া হয়েছে। চালক হেলপারকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
হ
আপনার মতামত দিন