বৃহস্পতিবার, ০১ জুন ২০২৩, ০৫:১৬ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক, সোনারগাঁও নিউজ :
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে এখন গ্রেপ্তার আতংঙ্কে রয়েছে সাদিপুর ইউনিয়নের বরগাঁও গ্রামবাসী। ওই গ্রামের নারী ও শিশু ছাড়া তেমন কোন পুরুষকে দেখা মিলছে না। দু’একজনকে দেখা পেলেও তারা কারো সঙ্গে কোন কথা বলছেন না। কথা বলতে চাইলেও তারা এড়িয়ে গিয়ে উধাও হয়ে যান। রোববার সোনারগাঁও থানায় র্যাব সদস্যদের দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার আতংঙ্কে বরগাঁও গ্রামের পুরুষরা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। গত রোববার রাতে র্যাব-১১ সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার নাছির উদ্দিন বাদি হয়ে সোনারগাঁও থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় ২১ জনের নামসহ প্রায় ৭০-৮০জনকে অজ্ঞাত আসামী করা হয়। র্যাবের মামলায় ইতোমধ্যে গুলিতে নিহত আবুল কাশেমের পরিবার সদস্য ও স্বজনদের গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজাতে পাঠিয়েছে পুলিশ। একটি সাধারণ ঘটনাকে কেন্দ্র করে র্যাবের গুলিতে নিহতের পরিবার প্রায় নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। একদিকে শোকের মাতম অন্যদিকে গ্রেপ্তার আতঙ্ক। পাশাপাশি পরিবারের উপর্জনক্ষম লোকজন পালিয়ে বেড়ানো। এটা কোনভাবেই মানতে পারছেন না ওই পরিবারের লোকজন।
এদিকে র্যাবের গুলিতে আবুল কাশেম নিহত হওয়ার ঘটনার তিন দিন অতিবাহিত হলেও নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে কোন মামলা দায়ের করা সম্ভব হয়নি। নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে কোন মামলা হয়নি বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সোনারগাঁও থানার পরিদর্শক তদন্ত মোহাম্মদ আহসানউল্লাহ।
সরেজমিনে বরগাঁও এলাকায় গিয়ে জানা যায়, ওই গ্রামের লোকজন গ্রেপ্তার আতংঙ্কে রয়েছেন। অপরিচিত কেউ ওই গ্রামের ঢুকলেই তাদের মধ্যে কৌতহল সৃষ্টি হয়। জামদানি ও কুটির শিল্পের তৈরির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন গ্রামের অধিকাংশ মানুষ। যেখানে জামদানি তৈরির কারখানো গুলো কর্মব্যস্তার মধ্যে থাকতো। সেখানে কম লোকজনই কাজ করছেন। তবে এখন নারী ও কিশোরাই কাজ করছেন। পুরুষদের সেখানে দেখা মিলছে কম। এ গ্রামের মামলার ২১ জনের পরিবারের কোন পুরুষ সদস্য বাড়িতে দেখা যায়নি। তবে র্যাবের দায়ের করার মামলার তদন্তে গিয়েছেন তালতলা ফাঁড়ি পুলিশের ইনচার্জ পরিদর্শক জাকির রাব্বানী। তিনি ওই গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলছেন। এছাড়াও কথা বলেছেন র্যাবের গুলিতে নিহতের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে।
তদন্তকারী কর্মকর্তা জাকির রাব্বানী বলেন, ঘটনাটি গুরুত্বপূর্ন। তদন্তের আগে কিছুই বলা সম্ভব না। তদন্ত শেষে এ বিষয়ে কথা বলা সম্ভব হবে।
র্যাবের দায়ের করা মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার রাতে খুন হওয়া নারী গার্মেন্ট শ্রমিক রোজিনা হত্যার সঙ্গে জড়িত মো. সেলিম নামের এক আসামি আটক করতে শুক্রবার মধ্য রাতে সোনারগাঁওয়ে সাদিপুর ইউনিয়নের বরগাঁও চেয়ারম্যান পাড়া গ্রামে যায় র্যাবের একটি দল। সেলিমের বাড়ি থেকে তাকে গ্রেপ্তার শেষে নিয়ে আসার সময় সেলিম ডাক চিৎকার শুরু করে। এসময় মামলার আসামিরা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে এসে র্যাবের উপর হামলা চালিয়ে সেলিমকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। র্যাব তখন আসামিদের বোঝানোর চেষ্টা করলে গ্রামবাসীদের নিয়ে তারা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে র্যাবের ওপর হামলা চালায়। এসময় আসামিরা আগ্নেয়াস্ত্র থেকে গুলি ছোড়ে। তখন আসামিদের ছোঁড়া গুলিতে একজন ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এছাড়াও আসামিদের হামলায় র্যাবের ৪ জন আহত হয়। এ ঘটনার পর আহত সদস্যদের হাসপাতালে ভর্তি করে র্যাব পুনরায় ওই এলাকায় গিয়ে জানতে পারে আবুল কশেম নামের এক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন।
গ্রামবাসী জানায়, আমির আলীর পালিত ছেলে সেলিমের গতকাল সোমবার আড়াইহাজারে পাচরুখি বিয়ে হওয়ার কথা। বিয়ে বাড়িতে গভীর রাতে অস্ত্রসহ অপরিচিত লোকজন আসায় হট্টগোল হয়। এ কারনে আশপাশের লোকজন এগিয়ে আসেন। স্থানীয়রা অপরিচিতদের ডাকাত বলে সন্দেহ করেন। এক পর্যায়ে ৯৯৯ এ ফোন করে পুলিশের সাহায্য চান। পরে স্থানীয়রা ডাকাত, ডাকাত বলে চিৎকার শুরু করলে আরো লোকজন এগিয়ে এসে জড়ো হয়। তখন নিজেদের র্যাব সদস্য বলে পরিচয় দেন অভিযানে যাওয়া ব্যক্তিরা। তখন গ্রামবাসীর সঙ্গে র্যাবের সংঘর্ষ বাধে। সংঘর্ষে র্যাবের গুলিতে আবুল কাশেম নামের বৃদ্ধ নিহত হয়।
জানা যায়, রূপগঞ্জের এসিএস টেক্সটাইল মিলে চাকরির সুবাদে পরিচয় হয় রোজিনা আক্তার ও সেলিমের। সেই থেকে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। বৃহস্পতিবার রাতে হত্যার শিকার রোজিনা আক্তারের তার স্বামীকে এক বছর আগে তালাক দেয় সে। সেলিম রোজিনাকে বিয়ের প্রতিশ্রæতি দেয়। এরই মধ্যে সেলিমের বিয়ে ঠিক হয় আড়াইহাজারের পাঁচরুখি এলাকায়। সোমবার তার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। বিয়ের কথা জানতে পেরে রোজিনা বিয়ে করার জন্য সেলিমকে চাপ দেয়। সেলিম তাতে রাজি না হলে এনিয়ে তাদের ঝগড়া হয়। এর জেরেই গত বৃহস্পতিবার রাতে সাদিপুর ইউনিয়নের গজারিয়াপাড়া এলাকায় সেলিম রোজিনার গলা কেটে হত্যা করে। শুক্রবার সকালে রোজিনার লাশ উদ্ধারের পরপর র্যাব, পুলিশ, ও ডিবির একটি দল হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করে। হত্যার শিকার গার্মেন্ট কর্মীর সঙ্গে থাকা জাতীয় পরিচয়পত্রের সূত্র ধরে মোবাইল নাম্বার কল লিস্টের সূত্র ধরে সেলিম ও সাইফুল ইসলাম নামে দু’জনকে শনাক্ত করে পুলিশ। পরে শুক্রবার রাতে সাইফুলকে আটকের পর সেলিমকে আটকের জন্য তার বাড়িতে অভিযান চালায় র্যাব। সেলিমকে গ্রেপ্তারের সূত্র ধরে র্যাবের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হন ওই এলাকার আবুল কাশেম। এ ঘটনায় র্যাব নিহতের ছেলেসহ ২১জনের নাম উল্লেখ করে ৭০-৮০জনকে আসামী করে। সেই মামলায় নিহতের পরিবারের কেউ জেলে, কেউ আহত, কেউ গ্রেপ্তার আতংকে পলাতক রয়েছে। ফলে উপার্জনক্ষম পরিবারটি এখন নিঃস্ব।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন জানান, যেখানে র্যাবের নামে মামলা হওয়ার কথা, সেখানে উল্টো র্যাব গ্রামবাসীর নামে মামলা দিয়ে হয়রানী করছে। বিভিন্ন সময়ে পুলিশ আসে। আতংঙ্ক সৃষ্টি করে। কখন কাকে ধরে নিয়ে যাবে সেটা বলা মুশকিল। তারা আরো জানান, রোববার রাতে এ গ্রামের কোন পুরুষ মানুষ বাড়িতে ছিল না। সকলেই দূরে গিয়ে রাত কাটিয়েছেন। একদিকে গ্রেপ্তারের ভয় অন্যদিকে চুরি, ডাকাতি ও নারীদের নিরাপত্তার ভয়। এখন ভয় আর ভয়। এগুলো আমাদের মানুষিকভাবে অশান্তি রাখছে। এগুলোর কি কোন সুরাহা হবে না?।
নিহতর স্ত্রী রমিজা বেগম বলেন, এখন আমাদের কাদার মতো সময় নেই। মামলা করবো কিভাবে? আমার স্বামীকে হত্যার পর আমাদের পরিবার এখন নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। দুই ছেলে র্যাবের মামলার আসামী। একজন জেলে অন্যরা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আগামী দু’মাসের মাথায় এক ছেলের এসএসসি পরীক্ষা। আমার পুরুষ বলতে বাড়িতে কেউ নেই। মামলা করবো কার নামে?। আমাদের মামলায় কারো কিছু হবে না। মামলা করে লাভ কি? আমার স্বামী সন্তানদেরকে ফিরিয়ে দেন।
নিহতের পূত্র বধু র্যাবের মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া নজরুল ইসলামের স্ত্রী আমিনা বেগম সোনারগাঁও নিউজকে জানান, আমাদের ওপর মানসিক অত্যাচার করা হচ্ছে। আমার শশুরকে র্যাব গুলি করে মারলো। আমার স্বামী ও সন্তানকে র্যাবের লোকজন ধরে নিয়ে গেল। ছেলেকে ছেড়ে দেওয়া হলেও স্বামীকে মিথ্যা মামলায় জেলে পাঠালো। শোক শেষ করতে পারছি না আবার মামলা করার সময় কোথায়?।
র্যাবের গুলিতে আহত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন গ্রাম্য চিকিৎসক হুমায়ুন কবিরের স্ত্রী সুলতানা বেগম জানান, এমন ঝামেলা হবে জানলে হয়তো ওই রাতে স্বামী সন্তানকে বের হতে দিতাম না। উপকারের জন্য বের হয়ে এখন বাবা ছেলে মামলার আসামী। আমার স্বামী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালে চিৎিসাধীন। পায়ে গুলি লেগে হাসপাতালে ভর্র্তি। আসামী হওয়ার পর বেশি ভয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় গ্রেপ্তার হলে উপায় কি হবে। এ সমস্যাগুলো শেষ কোথায়।
র্যাবের মামলার গ্রেপ্তার হওয়ার আসামী আমানউল্লাহর স্ত্রী রানী আক্তার জানান, র্যাব দোষ করলো কেউ বিচার করবো না। আল্লাহ একদিন ঠিকই বিচার করবো। আমাদের লোক মারা গেলো। আবার আমাদের মামলা দিয়ে জেলে পাঠালো।
সোনারগাঁও থানার পরিদর্শক তদন্ত মোহাম্মদ আহসানউল্লাহ সোনারগাঁও নিউজকে জানান , র্যাবের ওপর হামলার ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। সেই মামলায় ৬জনকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। নিহত আবুল কাশেমের পরিবারের কেউ মামলা করার জন্য আসেনি।
আপনার মতামত দিন