রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:০৫ পূর্বাহ্ন
হাসান মাহমুদ রিপন :
জমি নিয়ে বিরোধে নিহত দুই ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় মা ষাটোর্ধ্ব জহুরা বেগম। তিনি তিন ছেলেকে নিয়ে কাঁচপুরের পাঁচপাড়া এলাকায় বসবাস করেন। এক ঘটনাতেই গোটা পরিবার নিমেষেই শেষ হয়ে গেল। জমি নিয়ে বিরোধের জেরে চাচা ও চাচাতো ভাইদের হাতে খুন হয় তার দুই ছেলে। অপর মোজো ছেলের অবস্থাও আশংকাজনক। তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
মা জহুরা বেগম বিলাপ করে বলেন, ‘আমার সব শেষ হয়ে গেছে, আমি এখন কি নিয়ে বাঁচবো? আমার নাতি-নাতনিরা কাকে বাবা বলে ডাকবে? ওদেরকে এখন কে দেখবে? আল্লাহ কেন আমাকে এত বড় শাস্তি দিলো। সামান্য জমি নিয়ে ওরা আমার সন্তানদের এভাবে খুন করতে পারলো। আল্লাহ ওদের মাফ করবে না। আমি ওদের ফাঁসি চাই। আমি আর কিছু চাই না।
সোমবার বিকেলে কাঁচপুর পাঁচপাড়া এলাকায় নিহত দুই ভাই আসলাম সানী ও শফিকুল ইসলাম রনির লাশ নিয়ে আসলে লাশের সামনে এসে বিলাপ করে সংবাদকর্মীদের সামনে নিহতদের মা জহুরা বেগম এমন কথা বলেন।
কাঁচপুর পাঁচপাড়া এলাকায় নিহত দুই ভাই আসলাম সানী ও শফিকুল ইসলাম রনির বাড়িতে সরজমিনে গেলে সংবাদ কর্মীদের সামনে নিহতের মা ও স্বজনদের শোকের মাতম দেখা যায়। স্বজনদের এলাকা আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে।
বাবাকে হারিয়ে নির্বাক সন্তান :
নিহত শফিকুল ইসলাম রনির ১৪ মাস বয়সী ছেলে আনাস আহমেদ আদনান। সারাদিন বাবার সঙ্গে খুনসুঁটিতেই ব্যস্ত সময় কাটতো তার। কিন্তু রোববার বিকেল থেকে বাবাকে না পেয়ে অনেকটাই নিশ্চুপ হয়ে গেছে সে। শিশু আদনান কিছু না বুঝলেও বাবাকে দেখতে না পেয়ে বিষন্ন মন। যার সাথে খেলা করতে দিন পার হতো আনাসের। গত দুইদিন ধরে সেই খেলার সঙ্গীকে কাছে পাচ্ছে না।
নিহত রনির স্ত্রী ও আনাসের মা সানজিদা আক্তার বিলাপের সুরে বলেন, রোববার থেকেই বাবাকে কাছে না পেয়ে ছেলেটা কেমন যেনো হয়ে গেছে। ভালো করে কথা বলতে না পারলেও বারবার বাবা বাবা শব্দ উচ্চারণ করছে। আমার ছেলেকে কি জবাব দিবো আমি? আমি তো একা হয়ে গেলাম। আমার ছেলেকে কিভাবে মানুষ করবো এখন?
তিনি আরও বলেন, আনাস ওর বাবার ভক্ত বেশি। বাবাকে না পেয়ে রোববার থেকেই ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করছে না। সামান্য জমি নিয়ে এভাবে জলজ্যান্ত দুটো মানুষকে হত্যা করে ফেললো ওরা? আল্লাহ ওদের ছেড়ে দিবে না। আমার ছেলেকে যারা বাবাহারা করেছে এর কঠিন বিচার আল্লাহ একদিন না একদিন করবেই।
স্বামীর শোকে তিন সন্তান নিয়ে পাগল প্রায় সোনিয়া আক্তার:
কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ওরা শুধু জায়গা-জমি চায়। জায়গা-জমির জন্য খুন করেছে। আমি বিচার চাই। ওরা প্রায় সময় আমাদের হত্যার হুমকি দিতো। আমার চাচাতো ভাসুর মোস্তফা ও তার পরিবারের অন্য সবাই মিলে পরিকল্পনা করে হামলা করে আমার স্বামী ও দেবরকে খুন করেছে।
নিহতদের বড় বোন শামসুন্নাহার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমার ভাইগো কোপাইয়া নির্মমভাবে মাইরা ফেললো। আগামী মার্চের ২ তারিখ আমাগো হজ্বে যাওয়ার কথা ছিল। রনিরও যাওয়ার কথা ছিল। এটা আল্লাহ আমাগো কোন হজ্বে পাঠাইয়া দিলো।
জমি নিয়ে দ্বন্ধে আদালতে ৩ মামলা:
বিরোধকৃত জমি নিয়ে উভয় পক্ষের তিনটি মামলা রয়েছে নারায়ণগঞ্জ আদালতে। ১২ শতাংশ জমি নিয়ে তাদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে দ্বন্ধ চলছিল। ২০১৭ সালে নারায়ণগঞ্জ আদালতে প্রথম মামলা হয়। দ্বিতীয় মামলা হয় ২০২০ সালে। হত্যাকান্ডে অভিযুক্তদের নির্মাণাধীন বাড়ির ১.৫ শতাংশ জায়গা নিয়ে আসলাম সানী তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। পরবর্তীতে তিনি ১৪৫ ধারা জারি করে নির্মাণাধীন বাড়ির কাজ বন্ধ করে দেয়। সেই থেকে তার চাচা মহিউদ্দিন বিক্ষুদ্ধ হয়। সে থেকেই এ হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে স্বজনরা জানিয়েছেন।
নিহত দুই ভাইয়ের লাশ দাফন:
প্রতিপক্ষ চাচা ও চাচাতো ভাইদের পরিকল্পিত হত্যার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ময়নাতদন্ত শেষে তাদের গ্রাম কাঁচপুর পাঁচপাড়ায় গতকাল সোমবার বিকেল সাড়ে ৪ টায় লাশ নিয়ে আসলে হৃদয় বিদারক ঘটনার অবতারণা হয়। এসময় আত্মীয় স্বজন তাদের লাশের পাশে বিলাপ করে মাটিতে গড়াগড়ি করতে থাকে। অনেক স্বজন লাশ দেথে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। নিহত দুই ভাইয়ের লাশের জানাযা বাদ মাগরিব মঞ্জুরখোলা ঈদগাহ মাঠে অনুষ্ঠিত হয়ে রহিম স্টীল মিলের কবরস্থানে তাদের দাফন করা হয়।
নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) চাইলাউ মারমা বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিহত দুই ভাইয়ের লাশ ময়না তদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ঘটনার সাথে জড়িতদের গ্রেপ্তারে ইতোমধ্যে পুলিশ অভিযান শুরু করেছে। আশা করি শীঘ্রই তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে। নিহত দুই ভাইয়ের হত্যাকান্ডের ঘটনায় কোন মামলা বা আসামী গ্রেপ্তার সম্ভব হয়নি।
উল্লেখ্য উপজেলার কাঁচপুর ইউনিয়নের পাঁচপাড়া এলাকায় সরকারী অর্থায়নের একটি রাস্তা ও ড্রেন নির্মাণের জায়গা নিয়ে গত রোববার দুপুর ১টার দিকে নিহত আসলামের সঙ্গে তার চাচাতো ভাই মোস্তফা মিয়ার তর্ক বিতর্ক হয়। এক পর্যায়ে উত্তোজিত হয়ে মোস্তফার নেতৃত্বে মামুন, মাফিজুল রহমান, মারুফ, চাপাতি, রামদা ও লোহার রড নিয়ে আসলাম সানী, মো. শফিকুল ইসলাম রনি ও রফিকুল ইসলামের ওপর হামলা করে। এসময় তাদের কুপিয়ে ও পিটিয়ে মারাত্ব্কভাবে আহত করে। আহত অবস্থায় দুপুর আড়াইটায় তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক মো. আসলাম সানী ও শফিকুল ইসলাম রনিকে মৃত ঘোষনা করে।
আপনার মতামত দিন