রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৩:৩৮ পূর্বাহ্ন
অসিত কুমার দাস :
লাখো পূণ্যার্থীর অংশগ্রহনের মধ্য দিয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মহাতীর্থ নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দে আদি ব্রহ্মপুত্র নদে মহাষ্টমী স্নানোৎসব সম্পন্ন হয়েছে। শুক্রবার রাত ৯টা ১১ মিনিট ৫৭ সেকেন্ডে স্নানের লগ্নের মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে শনিবার রাত ১১টা ৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ডে শেষ হবে এ মহাষ্টমী স্নানোৎসব। মহামারী করোনায় গত দুই বছর বন্ধ থাকার কারনে এবার পূন্যর্থীদের ঢল নামে লাঙ্গলবন্দে। মহামারি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসায় চলতি বছর এ উৎসবের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আয়োজকরা। এ উৎসবে বাংলাদেশের পাশাপাশি অংশ নিয়েছেন ভারত, নেপাল, ভুটানসহ কয়েকটি দেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও ও বন্দরের সীমানা দিয়ে বয়ে যাওয়া লাঙ্গলবন্দে ব্রক্ষ্মপুত্র নদে দুই তীরে ১৮ ঘাটে লাখের বেশী পুনার্থী স্নান উৎসবে অংশ নেয়।
পৌরনিকমতে, হিন্দু দেবতা পরশুরাম হিমালয়ের মানস সরোবরে গোসল করে পাপমুক্ত হন। লাঙ্গল দিয়ে চষে হিমালয় থেকে এ পানিকে ব্রক্ষ্মপুত্র নদে নামিয়ে আনেন সমভূমিতে। পৌরাণিক এ কাহিনীকে স্মরন করে প্রতিবছর চৈত্রমাসে নির্ধারিত দিনে দেশ বিদেশের লাখ লাখ তীর্থযাত্রী পুন্যলাভের আশায় জড়ো হন। লগ্ন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাপমুক্তির বাসনায় স্নানোৎসবে মেতে ওঠেন পুণ্যার্থীরা। তারা ‘হে মহাভাগ ব্রহ্মপুত্র হে লোহিত্য আমার পাপ হরণ কর’ এই মন্ত্র পাঠ করে ফুল, বেলপাতা, ধান, দূর্বা, হরীতকী, ডাব, আম্রপল্লব সহযোগে পুণ্যার্থীরা ১৮ টি স্নানঘাটে দল বেধে সপরিবারে কেউবা এককভাবে ধর্মীয় রীতি রেওয়াজ অনুযায়ী স্নানে অংশ নেন।
ফুল, বেলপাতা, ধান, দূর্বা, হরীতকী, ডাব, আম্রপল্লব নিয়ে স্নানে অংশ নিতে ব্রহ্মপুত্র নদে দু’পাশে সোনারগাঁওয়ে ও বন্দরের লাঙ্গলবন্দে তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে পুণ্যার্থীর ঢল নামে। স্নান করতে নলিত মোহন সাধু ঘাট, অন্নপূর্ণা ঘাট, রাজঘাট, মাকরী সাধু ঘাট, গান্ধী (শ্মশান) ঘাট, ভদ্রেশ্বরী কালী ঘাট, জয়কালী মন্দির ঘাট, রক্ষাকালী মন্দির ঘাট, পাষাণ কালী মন্দির ঘাট, প্রেমতলা ঘাট, মণি ঋষিপাড়া ঘাট, ব্রহ্ম মন্দির ঘাট, দক্ষিণেশ্বরী ঘাট, পঞ্চপাণ্ডব ঘাট, পরেশ মহাত্মা আশ্রমসহ ১৮টি ঘাটে ভীড় করে।
এদিকে এ স্নানোৎসবকে কেন্দ্র করে বসেছে তিনদিন ব্যাপি বারোয়ারী মেলা। তিন কিলোমিটার এলাকায় নদের তীরে বসেছে এ মেলা। মেলায় চুড়ি, ফিতা, আলতা থেকে শুরু করে বাংলাদেশের ঐতিহ্যের শীতল পাটি, মাটির তৈরি বিভিন্ন তৈজসপত্র, খেলনা, একতারা, ঢোল বিক্রি হচ্ছে। এছাড়াও রয়েছে নিমকি, পিঠা, মিষ্টি, সন্দেশসহ রকমারি খাবারের দোকান।
স্নানোৎসবকে কেন্দ্র করে লাঙ্গলবন্দ এলাকায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। নেয়া হয় ৩ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেয়া হয়েছে তীর্থস্থান লাঙ্গলবন্দ। পুলিশ, র্যাব ও আনসারের প্রায় ১৫শ’ সদস্য নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। পূর্নার্থীদের নিরাপত্তার জন্য বসানো হয়েছে ৭টি ওয়াচ টাওয়ার ও ১০টি চেকপোস্ট। এ ছাড়া সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছে তীর্থস্থানের ৩ কিলোমিটার এলাকা।
গত ২০১৫ সালে রাজঘাটের কাছে ব্রিজ ভেঙ্গে পড়ার গুজবে হুড়োহুড়িতে ১০ জনের প্রাণহানী ঘটে। ঘটনাটি স্নানার্থীদের স্মরণ থাকলেও এ নিয়ে তাদের মধ্যে কোন ভয় বা আতংক নেই বলে জানান তীর্থযাত্রীরা।
কুমিল্লার দেবীদ্বার থেকে আসা তীর্থযাত্রী গীতারানী জানান, ব্রহ্মপুত্র নদে স্নান করলে পাপ মোচন হয়, ব্রহ্মার কৃপা লাভ করা যায়। তাই তিনি প্রতি বছর স্নানোৎসবে অংশ নেন। এবার তিনি একা আসেননি। নদী পথে ট্রলার নিয়ে পাড়া প্রতিবেশীদের নিয়ে স্বপরিবারে লাঙ্গলবন্দে এসেছেন।
ফেনী থেকে ছেলে ও তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে এসেছেন বিশ্বজিত। তিনি বলেন, পুণ্যের আশায় স্নান করতে এসেছি। এর আগেও কয়েকবার এসেছি। এখানে স্নান করলে ভগবান সব পাপ মোচন করেন।
স্নান উৎসবে অংশ নেয়া মিহির বাবা ও পুস্প রানী বালা জানান, জীবনে জেনে না জেনে অনেক পাপ করেছে। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে পায়ের নীচে চাপা পড়ে একটি পিপড়ার মৃত্য হয় থাকে সেটি হলো জীব হত্যা। তাই এই পাপ থেকে পরিত্রানের আশা ব্রক্ষপুত্র নদে স্নান করছি পুন্যলাভের আশায়।
এদিকে স্নান উৎসবে পূন্যার্থীদের স্বাস্থ্য সেবা, শুকনো খাবার, শিশুদের জন্য দুধ বিতরণসহ নানা ভাবে সহায়তা করছে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গুলো কাজ করছেন। লোকনাথ ব্রহ্মচারী আশ্রম, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, ১ নং ঢাকেশ্বরী টিন লাইন ও বনগুন মিলন সংঘ, নিপসম, সেবা সংঘ, হিন্দু কল্যাণ পরিষদসহ অর্ধশত স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান দর্শনাথীদের খাবার সরবরাহ ও অন্যান্য সেবা প্রদান করেন। এছাড়াও বন্দর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের উদ্যোগে দেয়া হচ্ছে পূণ্যার্থীদের স্বাস্থ্য সেবা।
লাঙ্গলবন্দ স্নান উদযাপন কমিটির সভাপতি ষড়জ কুমার সাহা জানান, স্নানোৎসবে অংশ নিতে দেশ ও দেশের বাইরে থেকে পুণ্যার্থীরা আসেন। বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য ৪৭টি নলকূপ ও ২৫টি ৫শ’ লিটারের পানির ট্যাংক বসানো হয়েছে। দুই বছর করোনা মহামারিতে বন্ধ থাকা ও সপ্তাহের ছুটির দিন হওয়ায় ভক্ত সমাগম বেশি হয়েছে। এই পুণ্যার্থীদের জন্য ৪০টি সেবাক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। প্রসাদ, জলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদের সেবায় ৩০০ স্বেচ্ছাসেবক কাজ করে। নিরাপত্তায় পুলিশ, র্যাব, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা ছিলেন। সিভিল সার্জনের পক্ষ থেকে মেডিক্যাল ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও বিআইডব্লিউটিএ, ফায়ার সার্ভিসসহ অন্য প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানগুলোও কাজ করেছে।
নারায়ণগঞ্জ পুজা উদযাপন কমিটির সাধারন সম্পাদক শিপন সরকার জানান, জেলা প্রশাসনের সহায়তায় ১৮ ঘাটে পর্যাপ্ত চেঞ্জিং রুম ও টয়লেট নির্মাণ করা হয়েছে। পুন্যার্থীরা স্নান শেষ করে ভালো ভাবে তাদের কাজ সম্পন্ন করতে পেরেছে। ২০১৫ সালে সরু রাস্তা ও অতিরিক্ত মানুষের চাপে স্নান উৎসবে আসা ১০ পূণ্যার্থী পদদলিত হয়ে মারা যায়। ওই বছরই সরকার লাঙ্গবন্দের উন্নয়নের জন্য মহাপরিকল্পনা নিয়ে ১২শ’ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয়। এরই মধ্যে রাস্তা প্রশস্ত করণ ও ঘাট সংস্কার করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে নানা কারনে মেঘা প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ বন্ধ রয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার মো: জায়েদুল আলম জানান, স্নান উৎসব সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পুলিশ, র্যাব ও আনসারসহ প্রায় ২ হাজার আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্য একযোগে কাজ করেছে। উপর থেকে নজর রাখতে ওয়াচ টাওয়ার এবং সিসি টিভি ক্যামেরা স্থাপন করেন জেলা পুলিশ প্রশাসন। পুলিশের কন্ট্রোল রুমও খোলা হয়েছে। কোন অপ্রিতিকর ঘটনা ছাড়াই শান্তিপুর্নভাবে শেষ হয়েছে পুন্যস্নান।
আপনার মতামত দিন